নৈতিকতার অবক্ষয় ও মৃতপ্রায় মূল্যবোধ এবং আমাদের করণীয়

শাফায়াত সজল : আমাদের এই প্রিয় দেশে মাঝে মাঝেই ঘটে এমন সব ঘটনা যা পুরো দেশে আলোড়ন তোলে বা তোলপাড় করে দেয়। তারপর বেশ কিছুদিন যাবত চলে মানববন্ধন, অবস্থান ধর্মঘট, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শোক, নিন্দা আর সমবেদনার ঝড়। তারপর আবার সব কিছু হয়ে যায় নিস্তদ্ধ নেমে আসে শুনসান নিরবতা। এভাবেই চলে বেশ কিছুদিন। তারপর আবারও হঠ্যাৎ একদিন ঘটে কোন ঘটনা এবং তারপর চক্রাকারে পূর্বের মতই সম্পন্ন হয় সব কার্যক্রম। আমি এইসব কার্যক্রমের ঘোর বিরোধী নয়। আমি বিশ^াস করি আধুনিক এই যুগে আধুনিকতার স্বচ্ছ ব্যবহার অর্থ্যাৎ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সঠিক ব্যবহারের ফলে আমরা যেমন অজানা অনেক কিছু জানতে পারছি ঠিক তেমনি এর সুফল পাচ্ছে যেকোন অন্যায়ের শিকার হওয়া ভুক্তভোগীরা। আগেই বলে রাখি আমি কিন্তু আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি বিরোধী না। আমি বর্তমান সময়ের ইন্টারনেট সম্পর্কিত সকল কিছুর সঠিক ব্যবহারের পক্ষে। সে আর একদিন বলবো, আজ আমার লেখার বিষয়টি ভিন্ন।

প্রথমেই বলে রাখি আমার বিজ্ঞদের মত শুদ্ধ হস্ত ও তথ্য ভান্ডার অতটা সমৃদ্ধ নয় বিধায় ভুলগুলো ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন প্রিয় পাঠক। আমার মতে কালের বিবর্তনে অপরাধ ছিলো আছে এবং হয়তো থাকবে। অপরাধ হয়তো তার রুপ আর ধরণ পাল্টাবে। অপরাধ নিয়ন্ত্রন করা যায় বা এর পরিমাপ আছে বলে আমি মনে করি। অপরাধ নিয়ন্ত্রনের জন্য বর্তমান সরকার যেমন আইন শৃংখলায় নিযোজিত বাহিনীকে করেছে অন্যান্য সময়ের চেয়ে আধুনিক তেমন চৌকসও। অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের দেশের পুলিশ সদস্যদের সংখ্যা তুলনামূলক কম। তবুও তারা দিনরাত পরিশ্রম করে শান্তি রক্ষায় কাজ করে যাচ্ছে। এখন আসি মূল কথায় বর্তমান সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি সমালোচিত বিষয় হচ্ছে দূর্ঘটনাস্থলে স্বশরীরে উপস্থিত থাকা ব্যক্তিদের ভূমিকা নিয়ে!! বিশ^জিৎ থেকে শুরু করে বরগুনার রিফাত হত্যা সবগুলোর ভিডিও ফুটেজ ভালভাবে লক্ষ করলে দেখা যায়, ক্রাইমস্পটের চারপাশে অনেক লোক দাঁড়িয়ে খুন হওয়া দেখছে কিন্তু আতংকের বিষয় হলো তীব্র প্রতিবাদ করে তাদের বাঁচাতে কেউ এগিয়ে আসেনি। অন্যায় দেখে অন্যায়ের প্রতিবাদ না করাটা কাপুরুষতার লক্ষণ বলে মনে করি। তাহলে আমরা কি দিনদিন কাপুরুষ বনে যাচ্ছি?? কাপুরুষতার পরিচয় দেওয়া কি আমাদের জন্য সুখকর বা গর্বের হবে?? কি নির্মম আমরা!! কি পৈশাচিক আনন্দ পাই আমরা!! আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে কি আমরা বলতে পারবো আমাদের এই অপদার্থতার গুণগান।

ধিক আমাদের, শত ধিক আমাদের কাপুরুষতার। আমরা আমাদের নিজেদের বিবেকের কাছে কি জবাব দিবো?? উত্তর দিবার মত কিছু আছে কি ?? নিশ্চয় নেই। কারণ আমরা দিনদিন মেরুদন্ডহীন মানুষে পরিণত হয়েছি বা হচ্ছি। আমাদের চোখের সামনে একটি মানুষকে কুপিয়ে কুপিয়ে মারলেও আমরা কিচ্ছু করতে পারিনা এইটা বাঙ্গালী জাতী হিসাবে লজ্জার নয় কি?? তাহলে কি আমরা আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মকে কি দাসত্ব আর ভীরুতার শিক্ষা দিচ্ছি?? আমার মনে হয় এইসব প্রশ্ন্ অনেকেরই, কিন্তু তারা হয়তো কোথাও কথাগুলো বলার সাহস পায় না তাই বলেনা। আর আমরা সাধারণ মানুষেরা বলার সাহসই বা পাবো কোথা থেকে?? বললেই অনেকেরই হয়তো শুনতে হয়েছে,“ চিনিস আমাদের? জানিস আমাদের ক্ষমতা। আমরা ওমুক ভাইয়ের লোক, আমরা তমুক ভাইয়ের লোক”। তার উপর মাতব্বর গোছের কিছু মানুষের দাসত্বে ভরা পরামর্শ,“ নিজের খেয়ে নিজের পরে কেন ওদের সাথে লাগতে যাও?? নিজের চরকায় তেল দাও, জানো ওদের কত লোকজন আছে?? অন্যরা যদি সব দেখে চুপ থাকতে পারে তাহলে তুমি পারো না কেন”?? ইত্যাদি ইত্যাদি। অংকুরেই বিনষ্ট হয় প্রতিবাদের বোপন করা বীজটি। তবে সব বীজতো বিনষ্ট হয়না কিছু জন্মায়ও। আর জন্মায় বলেই সূর্যসেন, ক্ষুদিরাম, নেতাজী সুভাস বোস এর জন্ম হয়েছে। যাদের এক সময় পুরো দেশ, জাতি, সমাজ বিদ্রোহী ভাবতো। কিন্তু তারা যখন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সমাজ পরিবর্তনের ডাক দিয়েছে, মুক্তির সুবাতাস এনে দিয়েছে তখন মানুষ বুঝতে শিখলো বিদ্্েরাহই মুক্তির একমাত্র পথ। যারা একসময়ই একাই শুরু করেছিলো এই পরিবর্তনের ধারা তারা আজ ইতিহাসে অমর, তাদের শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করে পুরো বিশ^জাতি। আর অপরদিকে যাদের পিছনে ছিলো লোকবল ও অস্ত্রশস্ত্র আজ তারা ঘৃনিত। তাদের ঠায় হয়নি কোথাও। তারা নিক্ষিপ্ত হয়েছে আস্তাকুড়ে। এমনকি ইতিহাসও তাদের মাফ করেনি। কিন্তু প্রতিবাদের শুরুতো করতে হবে কাউকে না কাউকে। শুরু করলে একসময় সুফল মিলবেই। হয়তো সময় ও অনেক ত্যাগের বিষয় কিন্তু তাতে কি?? হতাশ হবার জাতী আমরা নয়। আমি তাই বলে বলছিনা সবাই কাপুরুষ। কিছু প্রতিবাদী মানুষ আছে বলেই আজও সামাজিক ভারসাম্য বিরাজ করছে। তবে তাদের প্রকাশ্যে বের হতে হবে, সাহসী মানুষের সংখ্যা বাড়াতে হবে। সাহস আছে সবার মধ্যই কিন্তু অনেকেরটা ঘুমানো। সেই ঘুমন্ত সাহসকে জাগাতে হবে, এই জন্য আমাকে আপনাকেই দায়িত্ব নিতে হবে। শুধু ঘরে বসে ফেসবুকে ষ্ট্যাটাস দিয়ে আর মাইকের সামনে কথা বলে দায়িত্ব পারি দিলে হবেনা তা বাস্তবে রুপ দিতে হবে আমাদেরই। এইটা আমাদের সামাজিক দায়িত্ব।

যেহেতু এই দেশ মাটি ও সমাজ আমাদের তাই আমাদেরকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে ন্যায়ের পক্ষ হবার। অপরাধীরা সংখ্যাই যতই হোক না কেন তারা শক্তিশালী নয় এইটা আমাদের মাথায় রাখতে হবে। ওদের হাতে অস্ত্র থাকলে আমাদের আছে সৎ সাহস ও মনোবল। ওদের লোকজন বেশী থাকলে আমাদের আছে নিপীড়িত মানুষদের দোয়া। আমাদের ভয় পেলে চলবে না। গুটি কয়েক অপরাধীদের কাছে আমরা জিম্মি হতে পারিনা, ওদের ভয়ে আমরা হাত পা গুটিয়ে বসে থাকতে পারিনা। এইটা কারো কাম্য হতে পারে না। আজ যদি অন্যজনের নির্যাতন দেখে সোচ্চার না হোন তাহলে একদিন সেই নির্যাতন আপনার উপরেও আসতে পারে। সুতরাং এখনই সময় গর্জে ওঠার, এখনই সময় দিন বদলের। সন্ত্রাসীদের কোন পরিচয় থাকতে পারেনা। সন্ত্রাসীদের আঘাতে রাস্তায় রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকা ছেলেটি কারো না করো সন্তান, কোন বোনের আদরের ভাই অথবা হাতে মেহেদী লাগানো কোন নিষ্পাপ মেয়ের স্বামী। আর কত রক্ত দেখলে আমরা প্রতিবাদী হবো, আর কত নির্যাতন দেখলে আমাদের বিবেক সাড়া দিবে বলতে পারেন?? তাই আসুন আমরা আমাদের বিবেককে জাগ্রত করি, যেকোন অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। প্রয়োজনে আইন শৃংখলা বাহিনীর সাহায্য নেই।

দেশ আমাদের, সমাজ আমাদের তাই অন্যায় রুখে দেওয়াটাও আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। নৈতিকতা ও মূল্যবোধের বির্সজন দিয়ে আরো কতদিন চলবো?? ভয়ে অন্যের দাসত্ব মেনে আর কত সময় চুপ করে থাকবো?? যদি তাই থাকি তাহলে আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম আর ঐসব নির্যাতিত নিপীড়িত ভুক্তভোগীদের করুণ মুখের চোখের ১ ফোঁটা পানিও আমাদের কোন দিন ক্ষমা করবে না।

লেখকঃ সংবাদকর্মী ও সংগঠক।

বারপুর, বগুড়া সদর,বগুড়া।



from BDJAHAN https://ift.tt/2OZtSPR
via IFTTT
Next Post Previous Post