অসহায়দের পাশে একুশে পরিষদের ‘মানবতার সাঁকো’

শ্রী মনোরঞ্জন চন্দ্র নওগাঁ প্রতিনিধি : চায়ের দোকান করে সংসার চালাতেন মানিক হোসেন। করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধে সরকারি বিধিনিষেধের কারণে প্রায় দুই মাস ধরে বন্ধ তাঁর একমাত্র আয়ের উৎস চায়ের দোকানটি। এ পরিস্থিতিতে ছেলে-মেয়েদের মুখে খাবার জোগাতে হিমশিম খাচ্ছিন তিনি। এ সময় বাড়িতে গিয়ে তাঁর পরিবারের জন্য ১মাসের খাদ্যসামগ্রী পৌঁছে দেন দুই তরুণ। সংসারের এই দুরাবস্থার সময় এই খাদ্যসামগ্রী পেয়ে বিস্মিত ও বেজায় খুশি চা বিক্রেতা মানিক। এভাবেই করোনা পরিস্থিতিতে কর্মহীন হয়ে পরিবার নিয়ে বিপদে পড়া হতদরিদ্র, নি¤œবিত্ত ও মধ্যবিত্ত মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছে নওগাঁর সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘একুশে পরিষদ নওগাঁ’। বৃহস্পতিবার বাড়িতে গিয়ে চা বিক্রেতা মানিকের হাতে খাদ্যসামগ্রী তুলে দেন একুশে পরিষদের কর্মীরা। সহায়তা পেয়ে হাসি ফুটে মানিকের মুখে। তিনি বলেন, ‘গত দুই মাস ধরে কি যে পরিস্থিতিতে আছি, সেটা একমাত্র আল্লাই জানে। ছেলে-মেয়েদের মুখে ঠিক মতো দুবেলা খাবার জোগাতে পারছিলাম না। সরকারি কোনো ত্রাণও পাইনি। দুর্যোগকালে এই চাল, ডাল, আলু পেয়ে কি যে উপকার হলো তা বলে বোঝাতে পারব না।’ নওগাঁ শহরের পোস্ট অফিস পাড়ায় অবস্থিত একুশে পরিষদের কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবী কর্মীরা ব্যস্ত। মেঝেতে বসে নানা বয়সের ৮-১০ জন কর্মী খাদ্যসামগ্রী বস্তাতে তুলছেন। খাদ্যসামগ্রীর সেই বস্তাগুলো নিয়ে মোটরসাইকেল কিংবা রিকশা-ভ্যানে করে বিতরণের জন্য ছুটছেন কেউ কেউ। সংগঠনের কর্মীরা জানালেন, শুধু আজই নয় করোনা সংকটের শুরুর পর থেকে গত প্রায় দুই মাস ধরে একুশে পরিষদের নওগাঁ কার্যালয়ে এটি প্রতিদিনের দৃশ্য। করোনা সংকটে দুর্ভোগে পড়া মানুষের সহায়তায় গত ২৫ মার্চ থেকে ফুড ব্যাংকিং কর্মসূচি চালু করেছে সংগঠনটি। তাঁদের এই কর্মসূচির নাম দেওয়া হয় ‘মানবতার সাঁকো’। এই কর্মসূচির আওয়তায় নূন্যতম চার সদস্যের একটি পরিবারে এক মাস কিংবা ১৫ দিনের জন্য খাদ্য সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। একটি পরিবারের এক মাসের খাদ্য সহায়তার জন্য ২ হাজার টাকার ফুড প্যাকেজে রয়েছে ৩০ কেজি চাল, দুই লিটার সয়াবিল তেল, ২ কেজি ডাল, ৫ কেজি আলু, ১ কেজি পেঁয়াজ, ১ কেজি মুড়ি এবং ১ কেজি লবণ। একটি পরিবারের ১৫ দিনের খাদ্য সহায়তার জন্য ১ হাজার টাকার ফুড প্যাকেজে রয়েছে ১৫ কেজি চাল, ১ লিটার তেল, আড়াই কেজি আলু, ১ কেজি পেঁয়াজ ও ১ কেজি লবণ। গত ২৫ মার্চ থেকে গত সোমবার পর্যন্ত (৫৪ দিন) দুই সহ¯্রাধিক (২ হাজার ৬৫) পরিবারকে খাদ্য সহায়তা দিয়েছে একুশে পরিষদ। এর মধ্যে ৩০ দিনের খাদ্য সহায়তা পেয়েছে ৮৩০টি পরিবার এবং ১৫ দিনের খাদ্য সহায়তা পেয়েছে ১ হাজার ২৩৫টি পরিবার। এ পর্যন্ত দুই লাখ ৮৯ হাজার টাকার খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করেছে সংগঠনটি। একুশে পরিষদ নওগাঁ স্থানীয়দের কাছে একটি পরিচিত সাংস্কৃতিক সংগঠন। সারাবছর ধরে নানা ধরণের সাংস্কৃতিক কর্মকাÐ করে থাকে সংগঠনটি। পাশাপাশি বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর নজির রয়েছে এই সংগঠনের। এবারেও চলমান করোনাসংকটে বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে একুশে পরিষদ। একুশে পরিষদের সদস্য সংখ্যা প্রায় দুই হাজার। চাকুরিজীবী, ব্যবসায়ী ও শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ এই সংগঠনের সদস্য। শুরুতে একুশে পরিষদের সদস্যরা নিজেরা চাঁদা তুলে করোনা পরিস্থিতিতে অসহায় হয়ে পড়া মানুষের মাঝে খাদ্যসামগ্রী বিতরণ শুরু করেন। পরবর্তীতে সমাজের আরও অনেক বিত্তবান মানুষ তাদের এই কার্যক্রমে আর্থিক সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেন। গতকাল মঙ্গলবার সকালে একুশে পরিষদের কার্যালয়ে খাদ্যসামগ্রী প্যাকেটজাত করার কাজ তদারকি করছিলেন একুশে পরিষদের সভাপতি ডিএম আব্দুল বারী। কাজ তদারকি করতে করতেই তিনি বললেন, একুশে পরিষদ নওগাঁ মূলত একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন হলেও। ১৯৯৪ সালে এই সংগঠনের যাত্রার পর থেকেই সাংস্কৃতিক কর্মকাÐের পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক কাজও করে আসছে। মানুষের বিপদে-আপদে সব সময় মানুষকে সহায়তার জন্য ছুটে গিয়েছেন সংগঠনের কর্মীরা। ডিএম আব্দুল বারী আরও বলেন, ‘চলমান বৈশ্বিক করোনা সংকটে দোকানপাট, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, কলকারখানা বন্ধ থাকায় বহু শ্রমজীবী মানুষ কাজ হারিয়েছে পরিবার নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। শুধু দিনমজুর শ্রমজীবী মানুষ করোনা পরিস্থিতিতে চাকরি হারিয়ে বিপন্ন অবস্থায় জীবন অতিবাহিত করছেন এমন মানুষের সংখ্যাও কম নয়। এই মানুষগুলোর মাঝে খাদ্য সহায়তা পৌঁছে দিতে গত প্রায় দুই মাস ধরে একুশে পরিষদের কর্মীরা কাজ করে যাচ্ছেন। চরম দুর্যোগের সময় মানুষকে সহায়তা করতে পারাটা সত্যিই অনেক তৃপ্তির।’ মানুষের কাছে খাদ্য সহায়তা পৌঁছে দেওয়ার এই কার্যক্রমকে ফুড ব্যাংকিং কর্মসূচি-মানবতার সাঁকো নাম দেওয়ার বিষয়ে একুশে পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা আল মেহমুদ বলেন, চলমান সংকটে খাবার অভাবে অসহায় ও বিপন্ন অবস্থায় জীবন যাপন রয়েছেন। আবার অনেক বিত্তবান মানুষ রয়েছেন যাঁরা অসহায় মানুষকে সহায়তা করতে চান। কিন্তু একার পক্ষে মানুষকে সহায়তা করা সম্ভব হয় না। ওই সব বিত্তবান মানুষ অসহায় মানুষকে সহায়তার জন্য একুশে পরিষদে আর্থিক সহায়তা দিচ্ছেন। তাঁদের সেই আর্থিক সহায়তায় অসহায় ও বিপন্ন মানুষের মাঝে খাদ্যসামগ্রী পৌঁছে দিচ্ছে একুশে পরিষদ। অর্থাৎ একুশে পরিষদ সমাজের সচ্ছল ও অসচ্ছল মানুষের মাঝে একটা মেলবন্ধন বা সাঁকো হিসেবে কাজ করছেন। এই খাদ্যসহায়তা বিতরণের এই কার্যক্রমের নাম দেওয়া হয়েছে ‘মানবতার সাঁকো’। তিনি আরও বলেন, ‘অনেক মানুষ কিংবা সংগঠন মানুষকে সহায়তা করে ফেসবুকে ছবি দিয়ে সেগুলোর ফলাও করছে। কিন্তু আমরা অসহায় মানুষের খাদ্যসামগ্রী তুলে দিয়ে সেই ছবি প্রচার করাকে নিরুৎসাহিত করছি। কারণ, মানুষ রয়েছেন যাঁদের ছবি কিংবা নাম প্রকাশ হলে বিব্রত বোধ করেন।’ কলেজ শিক্ষক সিদ্দিকুর রহমান বলেন, একুশে পরিষদের সদস্যরা কেউ কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নয়। নিঃস্বার্থভাবে তাঁরা মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। তাঁরা আছেন বলেই, এই সংকট মূহূর্তে অনেক বিপন্ন মানুষের মুখে হাসি ফুটছে। তাঁরা দুবেলা খাবার খেয়ে বাঁচতে পারছেন। তাঁদের এই কাজ সত্যিই প্রশংসনীয়।

Next Post Previous Post