যুদ্ধাপরাধী টিপু সুলতানের মৃত্যুদণ্ডের রায়

বিশেষ প্রতিনিধি : একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার রায় রাজশাহীর বোয়ালিয়ার মো. আব্দুস সাত্তার ওরফে টিপু সুলতানের বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের রায় দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
একাত্তরে টিপু সুলতান জামায়াতে ইসলামির ছাত্রসংগঠন ইসলামি ছাত্রসংঘের নেতা ছিলেন।
বিচারপতি শাহিনুর ইসলামের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল বুধবার এ রায় দেন। এটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের ৪১ তম রায়।
এরআগে আসামি টিপু সুলতানের উপস্থিতিতে গত ১৭ অক্টোবর উভয়পক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ (সিএভি) রাখেন ট্রাইব্যুনাল। বুধবার রায়ের দিন ঠিক করে দেন ট্রাইব্যুনাল।
মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজশাহীর বোয়ালিয়া এলাকায় নিরীহ মানুষকে হত্যা, অপহরণ, নির্যাতন, লুটতরাজসহ মানবতাবিরোধী বিভিন্ন অপরাধের দুটি ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে টিপুর বিরুদ্ধে।
ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউশনের পক্ষে এ মামলায় শুনানি করেন প্রসিকিউটর মো. মোখলেসুর রহমান বাদল, জাহিদ ইমাম ও সাবিনা ইয়াসমীন খান মুন্নী। আসামিপক্ষে ছিলেন আইনজীবী গাজী এমএইচ তামিম।
যুদ্ধাপরাধী টিপু সুলতানের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা ২০১৭ সালের ২ মে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগের তদন্ত শুরু করে। তদন্ত শেষে গতবছর ২৭ মার্চ ছাত্রশিবিরের এই সাবেক নেতার বিরুদ্ধে প্রতিবেদন দেয় প্রসিকিউশনের তদন্ত দল। গত বছর ২৯ মে প্রসিকিউশনের দেওয়া আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নিয়ে ৮ আগস্ট অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে টিপু সুলতানের বিচার শুরুর আদেশ দেয় ট্রাইব্যুনাল। তদন্ত কর্মকর্তাসহ মোট ১৪ জন এ মামলার শুনানিতে প্রসিকিউশনের পক্ষে সাক্ষ্য দেন। এছাড়া রাজশাহী জেলার রাজাকার তালিকা ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের রাজনৈতিক অধিশাখা এবং ১৯৭১ সালে বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদনও জব্দ তালিকার সাক্ষী হিসেবে তুলে ধরা হয়।
টিপু সুলতানের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের মধ্যে রয়েছে- অভিযোগ-১: একাত্তরের ২৬ সেপ্টেম্বর দুপুর দেড়টা থেকে পরদিন মধ্যরাত পর্যন্ত আসামি মো. আব্দুস সাত্তার ওরফে টিপু সুলতান ওরফে টিপু রাজাকার স্থানীয় অন্যান্য রাজাকার ও পাকিস্তানি সেনারা বোয়ালিয়া থানার সাহেব বাজারের এক নম্বর গদিতে (বর্তমানে জিরো পয়েন্ট) হামলা চালিয়ে আওয়ামী লীগ নেতা বাবর মণ্ডলকে আটক করে। তাকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুজ্জোহা হলে সেনা ক্যাম্পে নিয়ে দিনভর নির্যাতন করার পর গুলি করে হত্যা করে লাশ মাটিচাপা দেওয়া হয়।
২ নং অভিযোগে বলা হয়- একাত্তরের ২ নভেম্বর রাত আনুমানিক ২টায় আসামি টিপু সুলতান, স্থানীয় রাজাকার এবং ৪০ থেকে ৫০ জন পাকিস্তানি সেনা বোয়ালিয়া থানার তালাইমারী এলাকায় হামলা চালায়। সেখান থেকে আওয়ামী লীগ নেতা চাঁদ মিয়া, আজহার আলী শেখসহ ১১ জনকে আটক করে নির্যাতন চালানো হয়। তালাইমারী এলাকার ১২ থেকে ১৩টি বাড়ি লুটপাটও চালানো হয়। পরে আটক ১১ জনকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ শামসুজ্জোহা হলে বসানো অস্থায়ী ক্যাম্প ও টর্চার সেলে নিয়ে যাওয়া হয়। ৪ নভেম্বর মাঝরাতে নয় জনকে গুলি করে হত্যার পর লাশ মাটিচাপা দেওয়া হয়। সৌভাগ্যক্রমে প্রাণে বেঁচে যাওয়া বাকি দুই জনের মধ্যে একজন এখনও জীবিত আছেন। তিনিও এ মামলায় সাক্ষ্য দিয়েছেন বলে তদন্তকারী কর্মকর্তা মো. হেলাল উদ্দিন জানান।
নাটোরের লালপুর উপজেলার গোপালপুর ডিগ্রি কলেজ থেকে অবসরে যাওয়া টিপু সুলতানকে একাত্তরের ভূমিকার জন্য রাজশাহীর অনেকে চেনে ‘টিপু রাজাকার’ নামে। ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন বলছে, মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে মিলে স্থানীয় যে রাজাকাররা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে গণহত্যা চালিয়েছিল, তাদের মধ্যে টিপু সুলতানই বেঁচে আছেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় টিপু ছিলেন জামায়াতে ইসলামী ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের স্থানীয় কর্মী। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সেই ছাত্রসংঘ নাম বদলে হয় ইসলামী ছাত্রশিবির। টিপু শিবিরের রাজনীতিতেও যুক্ত ছিলেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে মামলার অভিযোগপত্রে। সেখানে বলা হয়, ১৯৮৪ সালের পর টিপুর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ততার আর তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে স্থানীয়ভাবে তিনি জামায়াতে ইসলামীর সমর্থক হিসেবে পরিচিত।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতিতে লেখাপড়া করা টিপু সুলতান ১৯৮৪ সালে নাটোরের গোপালপুর ডিগ্রি কলেজে যোগ দেন সকারী অধ্যাপক হিসেবে। ২০১১ সালে সেখান থেকেই তিনি অবসরে যান।

১৯৭৪ সালের ১০ অগাস্ট টিপু সুলতানকে গ্রেপ্তার করা হলেও পরে তিনি ছাড়া পেয়ে যান। ২০১৭ সালের ১ জানুয়ারি বিস্ফোরক আইনের এক মামলায় মতিহার থানার পুলিশ তাকে ফের গ্রেপ্তার করে। পরে তাকে যুদ্ধাপরাধ মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়।

Next Post Previous Post